দুমকি উপজেলা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধ :
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) দক্ষিণবঙ্গের সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সোমবার ৮ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির ২৪ তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর হতে উন্নত মেধা বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও পরিচিতি লাভ করেছে। যার পেছনে রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অদম্য আগ্রহ ও প্রচেষ্টা এবং কর্মকর্তা- কর্মচারীদের পরিশ্রম।
অবকাঠামোগত ধারাবাহিক উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়টি আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গতিধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সীমাবদ্ধতাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে চলছে।
পটুয়াখালী কৃষি কলেজ থেকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় :
দক্ষিণাঞ্চলের অবহেলিত জনগণের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সহজলভ্য করাই ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যে। এ প্রতিষ্ঠানটির একটি দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। এটি প্রথমে জনতা কলেজ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেসরকারি কৃষি কলেজ এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক কাঠামো এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এফিলিয়েশনের আওতায় পটুয়াখালী কৃষি কলেজ নামে বিএসসি এজি. (অনার্স) ডিগ্রি প্রদানকারী দক্ষিণ অঞ্চলের একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল।
আরওপড়ুন …
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে দক্ষিণ অঞ্চল সফরকালে ১৯৯৪ সালের ২২ অক্টোবর স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে লেবুখালীর পথসভায় তাঁর দেয়া প্রতিশ্রুতি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৮ সালের ১৫ মার্চ পটুয়াখালীর জনসভায় পটুয়াখালী কৃষি কলেজকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার ঘোষণা দেন।
পরবর্তীতে ২০০০ সালের ৮ জুলাই কৃষি কলেজের অবকাঠামোতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পবিপ্রবি আইন পাস হয় এবং ২০০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তব রূপ লাভ করে।
পবিপ্রবির অবস্থান ও আয়তন:
পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ১৫ কি.মি. উত্তরে এবং বরিশাল বিভাগীয় শহর থেকে ২৮ কি.মি. দক্ষিণে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের লেবুখালী থেকে ৫ কি.মি. পূর্বে পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস অবস্থিত। বহি.স্থ ক্যাম্পাস বরিশাল জেলার খানপুরা, বাবুগঞ্জে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয়তন ১০৯.৯৭ একরের মধ্যে মূল ক্যাম্পাস ৯৭ একর ও বহি. ক্যাম্পাস ১২.৯৭ একর।
পবিপ্রবির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও পরিচিতি:
সবুজঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়টির রয়েছে সুবিশাল মনোরম ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের উত্তর-পশ্চিমাংশে অত্যাধুনিক ছাত্র- ছাত্রী হল, পাশেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং মসজিদের পাশে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা হেলথ কেয়ার সেন্টার, উল্টো দিকে রয়েছে গ্রন্থাগার ভবন আর ক্যাম্পাসের পশ্চিম অংশ জুড়ে রয়েছে বিস্তৃত খেলার মাঠ।
পবিপ্রবিতে লালকমল, নীলকমল, তরঙ্গতনু নামে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন পুকুর রয়েছে । নীলকমলের ওপরে রয়েছে একটি সেতু,যা দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অন্যদিকেঅন্যদিকে লালকমল আর খেলার মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ছায়াঢাকা রাস্তা, যা প্যারিস রোড নামে পরিচিত। একটি প্রশস্ত রাস্তা ক্যাম্পাসের ওপর দিয়ে পূর্বের পীরতলা থেকে পশ্চিমের মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে।
এ সড়কের দক্ষিণ দিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন। মূল ক্যাম্পাসের পূর্বদিকে পীরতলা বাজার অতিক্রম করলেই ৫৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কৃষি গবেষণা খামার ও ছাত্র হল।
পবিপ্রবির বর্তমান অবস্থা:
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর এ পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। বর্তমানে ৮টি অনুষদ ও পোস্টগ্রাজুয়েট পর্যায়ে মোট ৪৩৩০ জন শিক্ষার্থী (স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি), ২৬৭ জন শিক্ষক, ১৯৫ জন কর্মকর্তা ও ৪৮২ জন কর্মচারী রয়েছে। কেবলমাত্র কৃষি অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে দেশ ও জাতির সময়োপযোগী চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি অনুষদের অধীনে ৯টি ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সম্পূর্ণ আবাসন সুবিধা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ৬ টি হল রয়েছে। বরিশালের বাবুগঞ্জের বহি.স্থ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আরো ২টি হল। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ডিজিটাল লাইব্রেরি। লাইব্রেরি ভবনে ৫৫ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বই, ইন্টারনেট ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক ভলিউম ও সাময়িকী রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা- কর্মচারীদের যাতায়াতের জন্য বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাসের সুবিধা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক- কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ডিজিটাল পরিচয়পত্র (ইলেকট্রনিক চিপ) করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের সকল হলসহ সর্বত্র ওয়াইফাই সুবিধা রয়েছে। অটোমেশন প্রক্রিয়ার কাজও চলমান রয়েছে।গবেষণা কার্যক্রম:
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং সেন্টার এর আওতায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৮০১ টি গবেষণা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
বর্তমানে নিজস্ব ও সরকারি অর্থায়নে ২০২২-২০২৩ সালে পরিচালিত গবেষণা প্রকল্প ১৫৩টি। পবিপ্রবিতে বেশ কয়েকটি উন্নত ও উচ্চফলনশীল ফলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে পিএসটিইউ বিলাতীগাব- ১, পিএসটিইউ বিলাতীগাব-২, পিএসটিইউ ডেউয়া-১, পিএসটিইউ ডেউয়া-২, পিএসটিইউ বাতাবি লেবু-১, পিএসটিইউ কামরাঙ্গা-১, পিএসটিইউ কামরাঙ্গা-২, পিএসটিইউ তেঁতুল-১, পিএসটিইউ বৈচী-১ অন্যতম। উপকূলীয় এলাকার জন্য উন্নত ক্রপিং সিস্টেম ও বায়োচার প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ১০০ টি দেশীয় জাতের পাঁচ শতাধিক ধানের গবেষণা ও সংগ্রহশালা তৈরি, ভুট্টা ও সূর্যমুখী চাষে স্ট্রিপ পদ্ধতিতে ২২- ২৫ শতাংশ বেশি উৎপাদনে সক্ষমতা আনয়ন এবং লবণাক্ততা ও জলামগ্নতাসহিষ্ণু ধান উৎপাদনের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। মাছের দ্রুত বৃদ্ধিকরণ প্রযুক্তি, শুটকি তৈরি ও সংরক্ষণের নিরাপদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং দেশের প্রথম ও একমাত্র জলহস্তীর কঙ্কাল প্রস্তুতকরণছাড়াও উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক গবেষণা চলমান।
কৃষিকে সমৃদ্ধ করতে প্রতিনিয়ত চলছে নানা ধরনের গবেষণা কার্যক্রম। এছাড়াও প্রোগাম বেইজড গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
শিক্ষার মান:
অত্যাধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবে খ্যাত আমেরিকার কোর্স ক্রেডিট সিস্টেম পদ্ধতি চালু রয়েছে। হাতে- কলমে শিক্ষাদানের জন্য এখানে রয়েছে ৩২টি আধুনিক গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি। রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংবলিত একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার মানেরও উন্নয়ন ঘটেছে। চতুর্থ শিল্প বিল্পবের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে কোর্স কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। চালু হয়েছে আউটকাম বেইজড কারিকুলাম। একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শতভাগ ডিজিটালের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সহ-শিক্ষা কার্যক্রম:
একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নিয়মিতভাবে বার্ষিক ক্রীড়া এবং আন্ত.অনুষদীয় টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে। সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য রয়েছে কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যান্ড দল। রয়েছে সাংবাদিক সমিতিসহ প্রায় অর্ধ-শতাধিক সমাজিক সংগঠন। যা স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক মাস্টারপ্লান এ পর্যন্ত তৈরি করা হয়নি। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত একাডেমিক মাস্টারপ্লানসহ ফিজিক্যাল মাস্টারপ্লান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সমুদ্র সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও গবেষণার জন্য কুয়কাটায় মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপনের নিমিত্তে ৬০০ কোটি টাকার ডিপিপি জমা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্থাপনা দৃষ্টিনন্দন ও পরিকল্পনামাফিক করার লক্ষ্যে মূল ক্যাম্পাস, বাবুগঞ্জ এএনএসভিএম অনুষদ এবং কুয়াকাটায় প্রস্তাবিত মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন্তর্ভূক্ত করে ফিজিক্যাল মাস্টারপ্লান তৈরি করার জন্য একটি ডিপিপি তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
শীঘ্রই এটি শিক্ষামন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে। এএনএসভিএম অনুষদকে আধুনিকায়ন করার জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। এই প্রকল্পে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগারসহ এ্যানিমেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মূল ক্যাম্পাসেও আধুনিক কেন্দ্রীয় গবেষণাগার স্থাপনের জন্য ডিপিপি তৈরি করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় গবেষণাগার দুইটিতে আধুনিক গবেষণাসহ পায়রা সমুদ্র বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত সকল কৃষি পণ্যের গুনাবলী পরীক্ষা করা হবে।
বাবুগঞ্জে এ্যানিমেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপিত হলে দক্ষিণাঞ্চলে মহিষ ও হাঁস লালনপালনের উপর গবেষণার মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। তাছাড়া ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ডিগ্রি প্রদানকারী (ইইই) বিভাগ, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ ও বায়োমেডিকেল বিভাগসহ অন্যান্য যুগোপযোগী বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে পটুয়াখালীসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মননশীলতা, আধুনিকতায় দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। এ অঞ্চলের অতীত গৌরবকে এ বিশ্ববিদ্যালয় আরও দৃঢ় ও সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণাঞ্চলের সত্যিকারের ‘বাতিঘর’ হয়ে উঠুক, এটাই আমার প্রত্যায় ব্যাকত করেন।