★মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা কি?
মানসম্মত শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা যা একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে সহায়তা করে। নতুন ধারণা অনুসন্ধানে পরীক্ষা – নিরীক্ষা করার ক্ষমতা অর্জনই মানসম্মত শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষায় আমরা মানসম্মত শিক্ষা বলতে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করাকে বুঝি।শিক্ষার্থীর ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাস্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন জরুরি।
★কেমন করে হতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন?
প্রাথমিক শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি অবশ্যই রোধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি ও পাঠে যথার্থ মনোযোগী করে তোলাই এর প্রধান উপায়। এর জন্য শ্রেণিকক্ষে আকর্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক পাঠদান, শিক্ষার্থী সম্পর্কে অভিভাবকদের মতামত জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ অর্থাৎ শিক্ষক অভিভাবক সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। শিক্ষক মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, হোম ভিজিট কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেন। নিয়মিত শ্রেণি পরীক্ষা, শ্রেণি মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। সমগ্র পাঠ্য বই যাতে খুটি নাটি পড়ানো হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নোট বই ও গাইড বইয়ে নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। শিক্ষার্থী প্রতিদিনের পাঠ ভালোভাবে শিখল কিনা শিক্ষক তা শ্রেণিকক্ষেই নিশ্চিত করবেন।
প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তা নিম্নরূপ-
ফলপ্রসূ প্রচারের মাধ্যমে নিরক্ষর পিতামাতাকে শিক্ষার মূল্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করতে হবে। সুন্দর সমাজের জন্য নারী শিক্ষার অপরিহার্যতা, বাল্য বিবাহের কুফল মানুষকে যথাযথভাবে অনুধাবন করাতে হবে।
শতভাগ ভর্তির হার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এবং ঝরে পড়ার হার হ্রাস করতে শতকরা ১০০ ভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় আনা। শিক্ষায় পরিবর্তনশীল ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নিয়মিত এবং শিক্ষক ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং নিশ্চিত করে শিক্ষক অভিভাবক কমিটি যা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষভাবে সহায়ক। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায়ই ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। তাই শ্রেণিকক্ষে বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা গ্রহণ, নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃপ্রণালীর ভাল ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয়করণকৃত শিক্ষক ৭০%, পুল নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ৫০%, প্যানেল নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ৫০% বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে একই পাল্লায় মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ধাবিত হওয়া সমস্যা হবে।
ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক মিলে বিদ্যালয় আঙিনায় গাছ লাগানো, বাগান করা, শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালানো। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শান্তি মুক্ত রাখা অর্থাৎ শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।
★ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ও আমাদের কাঠামোগত অবস্থান
বাংলাদেশের জাতীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুণগত ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অত্যাবশ্যক।
শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে শুধু ভালো নম্বর বা গ্রেড পেলে হবে না, পাশাপাশি নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে যেতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও মানসম্মত করতে বিভিন্ন যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সার্বজনীন ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে রয়েছে বিভিন্ন বহুমুখী চ্যালেঞ্জ।
প্রাক-প্রাথমিকে শিশুর নির্ধারিত বয়স ৪+ ও ৫+ বয়সী শিশু এবং সময়কাল দুই বছর। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণিকক্ষ সুসজ্জিতকরণ, শিশুদের প্রয়োজনীয় খেলনার ব্যবস্থা ও শ্রেণিকক্ষের চারটি কর্নার যথাযথভাবে তৈরি করাসহ যেসব নীতিমালা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিকে কোনো ধরনের লিখিত মূল্যায়নের বিধান রাখা হয়নি।
মূলত শিক্ষাদান বা শিখন-শেখানো পদ্ধতির কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থী ও তার শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে যোগসূত্র তৈরির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জনের চেষ্টা করা। শিখন-শেখানো কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদান হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ছিলেন শিক্ষাপ্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। কালের পরিক্রমায় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা মুখ্য বা কেন্দ্রবিন্দু।
★ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে আমাদের করণীয়
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সুশিক্ষা একটি জাতিকে উন্নত ও আধুনিক জাতিতে পরিণত করে। আমরা জানি শিক্ষা একটি বহুমাত্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।
শিশুরা বিদ্যালয়ে থাকে মাত্র কয়েকঘণ্টা অথচ অধিকাংশ সময় সে থাকে পরিবার ও সমাজে। তাই পরিবার ও সমাজকে শিশুর শিক্ষায় আরো যত্নশীল ও আন্তরিক হতে হবে। শিশুকে গৃহে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করতে হবে এবং সমাজকে স্থিতিশীল পরিবেশের নিশ্চয়তা প্রদান করে শিশুদের প্রকৃতি থেকে অবারিত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শিক্ষকদের ন্যায় ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার ব্যর্থতা ও সফলতা বেশির ভাগটাই নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। তারা যদি শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানতুল্য মনে করে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আগামী প্রজন্মকে নিয়ে সঠিক স্বপ্ন বুনে তাহলে সবই হয়, কিঞ্চিত বাকি থাকে আমদের জন্য। জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক যার যার অবস্থান থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
জনপ্রতিনিধিরা প্রতিনিয়িত জনগণের সংস্পর্শে থাকতে পছন্দ করেন, ঘুরে বেড়ায় মানুষের মাঝে। তারা স্কুল পরিদর্শন ও স্থানীয় বরাদ্দ প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারে। আর সংবাদিকরা সমাজের দর্পণ হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার ভালোমন্দ সঠিকভাবে তুলে ধরলে সবাই আরও দায়িত্বশীল হবে। অভিভাবকরা শুধু তার সন্তানকে ক্লাসে ফার্স্ট বানাতে ব্যস্ত থাকেন। সন্তানের অন্যান্য দিক যেমন-দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা, ধর্মীয় শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা ইত্যাদিতে মনোযোগ দেয় না। এর ব্যতিক্রম প্রয়োজন। তাছাড়া তারা শিক্ষকদের আস্থায় নেয় না এবং যথাযথ সম্মান দেয় না। এটিরও ব্যতিক্রম প্রয়োজন।
আরও অনেক কিছু বলার ছিল, থাক, শুধু এটুকু বলে শেষ করছি… সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে আমাদের আরও আন্তরিক, দায়িত্বশীল ও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
Subscribe to get the latest posts sent to your email.